২০১৮ সাল থেকে কোরিয়াতে E9 ভিসায় আসা প্রবাসীদের কাছ থেকে ১ লক্ষ টাকা জামানত নেওয়া শুরু হয় এবং সম্প্রতি ২০২০ সাল থেকে রি-এন্ট্রী কর্মীদের কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা জামানতের নোটিশ প্রসঙ্গে।
শুরুতেই বলে রাখি, এই ব্যাপারটির ক্ষেত্রে কোনভাবেই পক্ষে অথবা বিপক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। মূল কারণ হলো, পক্ষে যাওয়া মানেই হাস্যকর একটি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেওয়া আর বিপক্ষে যাওয়া মানে অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তার বিপক্ষে থাকা।
প্রথমেই কোরিয়ার দুইটি বীমা সম্পর্কে আলোচনা করি।
আমরা যখন প্রথম কোরিয়াতে আসি তখন ৫ লক্ষ উয়ন (প্রায় ৩৫ হাজার টাকা) কোরিয়ান শ্রম মন্ত্রণালয়ের স্যামসাং বীমাতে বাধ্যতামূলক জমা দেই। এটা কে বলা হয় ফেরত যাওয়ার বীমা। অর্থাৎ যখন আমরা কোরিয়া ছেড়ে একবারেই চলে যেতে চাইবো তখন এই টাকাটি প্লেনের ভাড়া বাবদ আমরা রিটার্ন পাবো। হোক আমরা মেয়াদ উত্তীর্ণ করি অথবা হঠাৎ করেই চলে যায়। কোরিয়াতে মাসিক ইনকাম এর চেয়েও অনেক বেশি হওয়া সত্ত্বেও শুধুমাত্র নিরাপত্তার কারণেই এই বীমাটি করা হয়।
এরপর অবসর ভাতা, কোন শ্রমিক কোরিয়ান মালিকের কাছে নিয়োগপ্রাপ্ত হলেই মালিককে বাধ্যতামূলক স্যামসাং বীমাতে একাউন্ট করতে হয়। প্রতিমাসে নির্দিষ্ট হারে মালিক সেই একাউন্টে টাকা জমা দেয়। শ্রমিক যদি ৩৬৪ দিন কাজ করার পর রিলিজ নেয়, অর্থাৎ এক বছর পূর্ণ না করে তাহলে সেই টাকাগুলো পুনরায় মালিকের একাউন্টে রিটার্ন চলে যায়। আর যদি এক বছর পূর্ণ হয় তাহলে শ্রমিকের একাউন্টে বহাল থাকে। এরপর যখনই সে কর্মী কোরিয়া থেকে শেষবারের মত বিদায় নিবে, ইমিগ্রেশন পার করেই সে টাকাগুলো ক্যাশ করে নিতে পারবে।
উপরোক্ত দুটি বীমার আলোচনার করার উদ্দেশ্য হল, বোয়েসেল প্রবাসীদের জন্য এমন একটি আইন প্রণয়ন করুক যা সকলের জন্য বিশ্বাসযোগ্য এবং গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে। বোয়েসেল ঠিক এমন চিন্তা করেই হয়তো কোরিয়ার অবৈধ অভিবাসন ঠেকাতে এ ধরনের জামানত নেওয়ার নিয়ম তৈরি করেছে। কিন্তু তাদের বোঝা উচিত, যে ব্যক্তি অবৈধভাবে থাকার সামান্যতম ইচ্ছাও রাখে তার কাছে এই জামানত আসলে কিছুই না। জামানতের লোভে অথবা তা হারানোর ভয়ে কেউ অবৈধ থাকবে না এমন চিন্তা করাটা বড়ই হাস্যকর। কারণ, সে এই সমপরিমাণ টাকা দু-এক মাসের মধ্যেই সে উপার্জন করে ফেলতে পারবে।
আমি নিজেও একজন প্রবাসী হিসেবে এবং অন্যান্য প্রবাসীদের আলোচনা বা ক্ষোভ থেকে যে জিনিসটি স্পষ্টভাবেই বুঝতে পারছি তা হল, আসলে জামানত রাখতে তেমন কারো সমস্যা না হলেও এই জামানত ফেরত পাবার ক্ষেত্রে সুস্পষ্ট নীতিমালা বা স্বচ্ছভাবে ব্যাখ্যা না থাকার কারণেই বোয়েসেল এর প্রতি প্রবাসীদের মধ্যে ক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আমি এখন পর্যন্ত ৪জন ব্যক্তিদের সাথে কথা বলেছি। তারা প্রত্যেকেই কোরিয়া আসার পর কোনো কারণবশত বৈধভাবেই কোরিয়া ছেড়ে চলে গেছে। কিন্তু আজ পর্যন্ত তারা সেই জামানতের টাকা ফেরত পায়নি। তন্মধ্যে দুজনকে বলা হয়েছে, যেহেতু আপনারা নির্দিষ্ট সময় শেষ করে আসেননি সুতরাং আপনারা টাকা পাবেন না এবং অপর দুজনকে অ্যাপ্লিকেশন করতে বলা হয়েছে, তারা করেছে, কিন্তু আজ অবধি তারা টাকাও পায়নি এবং কোন রিটার্ন কলও পাইনি। এরপর যারা কোরিয়াতে থেকে ভিসা বদল করেছে। অর্থাৎ অবৈধ হওয়ার সুযোগ নেই। তারাও আজ পর্যন্ত জামানতের টাকা ফেরত পাননি। বহুবার, ব্যক্তিগত পর্যায়ে দলগতভাবে ও সাংগঠনিকভাবেও এ ব্যাপারে বারবার প্রশ্ন করা হলেও তারা সদুত্তর দেয়নি। কিছু মানুষ রয়েছেন, যারা বোয়েসেলের এই বিজ্ঞপ্তিকে কেন্দ্র করে ফেসবুকে নানা ধরনের পোস্ট দিচ্ছেন আবার অনেকেই কোরিয়ার সামাজিক সংগঠনগুলোকে দোষারোপ করে চলেছে। কেন তারা প্রতিবাদ করছে না? কেন আন্দোলন করছে না?
আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই যে, বাংলাদেশ দূতাবাস সউলে একজন শ্রমসচিব রয়েছেন যিনি প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও বোয়েসেলের মাধ্যমে নিয়োগপ্রাপ্ত। আপনারা ইচ্ছা করলেই আপনাদের কথাগুলো তাকে জানাতে পারেন, পরামর্শ দিতে পারেন, এমনকি অনেক অজানা প্রশ্নের উত্তরও পেতে পারেন।
এজন্য মেইল করুন labourwingseoul@gmail.com
অথবা যোগাযোগ করুন 01091884056 নম্বরে।
বোয়েসেল একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান। বোয়েসেলের মাধ্যমে আমরা কোরিয়াতে এসেছি বা আসতে পেরেছি। তাদের প্রতি আমরা সবসময় কৃতজ্ঞ। তাই একজন প্রবাসী হিসেবে বোয়েসেলের প্রতি আমার আকুল অনুরোধ রইল নিম্নোক্ত বিষয়গুলি স্পষ্টভাবে বিবেচনা করে কোরিয়া প্রবাসীদের উদ্বেগ দূর করবেন।
১) যে কোন আইন প্রণয়নের ৩ থেকে ৪ মাস পূর্বে তা ঘোষণা দেওয়া এবং প্রবাসীদের মতামত ও পরামর্শ গ্রহণ করা।
২) জামানত প্রথা বিলুপ্ত করা যায় কিনা? অথবা জামানতের পরিমাণ কমানো যায় কিনা? অথবা জামানতের এই টাকাগুলো ইনস্টলমেন্টের মাধ্যমে দেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া যায় কিনা?
৩) রশিদ প্রদান করা। জামানতের সব ধরনের কাগজ জামানতকারীর কাছেও এক কপি করে দেওয়া।
৪) কোন কোন শর্ত ভঙ্গ করলে জামানতের টাকা ফেরত পাওয়া যাবেনা, তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা।
৫) যে সমস্ত ডকুমেন্ট লাগবে তা জামানতপত্রে নির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ থাকা।
৬) কেউ যদি ভিসা চেঞ্জ করে তবে তার জামানত ফিরিয়ে দেওয়া।
৭) প্রবাসে কেউ যদি মৃত্যুবরণ করে তবে তার পরিবারের কাছে জামানতের টাকা পৌঁছে দেওয়া।
৮) যদি শর্ত ভঙ্গ না হয়। তবে আবেদন করার সঙ্গে সঙ্গেই পূর্ণ জামানত ফিরিয়ে দেওয়া।
(আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, এই টেবিল সেই টেবিল, এই স্যারের সিগনেচার, ওই স্যারের সিগনেচার, এই কাগজ সেই কাগজ, অযথা সময়ক্ষেপন সহ এসব থেকে মুক্ত রাখা)
বিশেষ দ্রষ্টব্য: এটা সম্পূর্ণ আমার ব্যক্তিগত মতামত। একজন সাধারণ প্রবাসী হিসেবে আমার মনের কথাগুলো উল্লেখ করলাম। ভুল হলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন, ভালো লাগলে উৎসাহ দিবেন এবং খারাপ হলে গঠনমূলক সমালোচনা করবেন।
সেই সাথে সাথে কোরিয়ার সামাজিক ও আঞ্চলিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা তাদের নিজস্ব মতামত তাঁদের নিজস্ব গ্রুপগুলোতে আলোচনা করবেন বলে আশা করছি।
চাকরি বদল করলে জামানত বাজেয়াপ্ত করা উচিৎ হবে কিনা?
প্রথম কথা, চাকরি বদলের কারণগুলো খতিয়ে দেখলে এখানে ৯০% মালিকদেরই দোষ বা কারণ পাওয়া যাবে। কোম্পানি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার কারণে, কাজের চাপ কমে যাওয়ার কারণে, থাকা-খাওয়া বা বাসস্থান না থাকার কারণে, বেতন সুযোগ সুবিধাদি না দিতে পারার কারণে, অনেক মালিকগনই কর্মীদেরকে বাধ্য করে চাকরি ছাড়তে। এছাড়াও কর্মীদের শারীরিক সমস্যা ও অসুস্থতার কারণেও মালিকগণ অনেককেই স্বেচ্ছায় রিলিজ দিয়ে দেন। এক্ষেত্রে একজন কর্মীকে তার অনিচ্ছা সত্ত্বেও রিলিজ নিতে হয়।
বোয়েসেল এর স্ট্যাম্পে উল্লেখ রয়েছে যে,
“আমি নিয়মবর্হিভূতভাবে উক্ত কোম্পানির চাকরি পরিবর্তন করবো না বা অন্য কোম্পানিতে চাকরির জন্য চুক্তিবদ্ধ হব না”
“যদি আমি দক্ষিণ কোরিয়াতে অবস্থানকালে নিয়মবহির্ভূতভাবে নিয়োগদাতা কর্তৃক প্রদত্ত চাকরি ব্যতীত অন্য কোন কোম্পানিতে চাকরি গ্রহণ/ পরিবর্তন করি”
এখানে “নিয়মবহির্ভূতভাবে” কথাটি অবশ্যই ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন রয়েছে।
আমি আমাদের অভিভাবক দূতাবাসের মাধ্যমে বোয়েসেল এর জ্ঞাতার্থে জানাতে চাই যে, দক্ষিণ কোরিয়ার শ্রম মন্ত্রণালয়ের চাকরি বিষয়ক আইন খুবই স্বচ্ছ এবং কঠোর নিয়মতান্ত্রিক। এখানে কেউই নিয়ম বহির্ভূতভাবে চাকরি বদল করতে পারে না এবং এটি কখনোই সম্ভবও নয়। কোরিয়ার আইন অনুযায়ী, কোন কর্মী ইচ্ছা করলেই চাকরি বদল করতে পারে না। তাকে নির্দিষ্ট নিয়ম মেনেই চাকরি থেকে রিলিজ নিয়ে অন্য কোম্পানির সাথে শ্রম চুক্তি করতে হয়। তাই নিয়মবহির্ভূত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।
অতএব, বোয়েসেল কর্তৃক এ আইনটি বাতিল করাটাকেই উচিত মনে করি। উল্লেখ্য যে, ২০১৮ সালে ২৪৭ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যখন প্রথম জামানত প্রথা চালু হয় তখন বলা হয়েছিল শুধুমাত্র অবৈধভাবে অবস্থান রোধের লক্ষ্যেই এ আইনটি চালু করা হয়েছে।
সুতরাং, জামানত বাতিল আইনটি শুধুমাত্র অবৈধ অধিবাসী বা অবৈধ কর্মকান্ডকে ঘিরেই রাখাটাকেই সমুচিত মনে করি।
(Collected)